এক বিস্ময়কর ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্টোনভ এএন-২২৫ 'ম্রিয়া' (Mriya) স্ট্র্যাটিজিক কার্গো এয়ারক্রাফট!
বর্তমানে, এভিয়েশন প্রযুক্তির জগতে এক অভাবনীয় এবং বিস্ময়কর আবিষ্কার হচ্ছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আমলের তৈরি অ্যান্টোনভ এএন-২২৫ 'ম্রিয়া' (Mriya) স্ট্র্যাটিজিক কার্গো এয়ারক্রাফট। এটি মূলত গত ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং ভারবাহী কার্গো এয়ারক্রাফট হিসেবে টিকে ছিল। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গত ২০২২ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ চলাকালে রাশিয়ার মিসাইল হামলায় এই বিশাল আকারের আইকনিক কার্গো বিমানটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।
১৯৮৫ সালে কোল্ড ওয়ার চলাকালে অত্যন্ত সুবিশাল আকারের একটি মাত্র এএন-২২৫ 'ম্রিয়া' (Mriya) হেভি কার্গো এয়ারক্রাফট ডিজাইন ও তৈরি করে এভিয়েশন ম্যানুফ্যাকচারিং জায়ান্ট অ্যান্টোনভ ডিজাইন ব্যুরো। তাছাড়া এই কার্গো এয়ারক্রাফটের মতো এত বিশাল আকার ও ধারণক্ষমতার কোনো কার্গো বিমান সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যতীত আজ অব্ধি অন্য কোন দেশই তৈরি করতে পারেনি। আসলে ১৯৮০ সালের দিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেনে অ্যান্টোনভ ডিজাইন ব্যুরো এই বিমানটির ডিজাইন করে এবং এর প্রধান ডিজাইনার ছিলেন ভিক্টর তোলমাচেভ।
সোভিয়েত ইউনিয়নের অ্যান্টোনভ এভিয়েশন সংস্থা ১৯৮৫ সালে এর ডিজাইন ও তৈরি শেষ করলেও বাস্তবে এর প্রথম সফল উড্ডয়ন সম্পন্ন করা হয় ১৯৮৮ সালের ২১ ডিসেম্বর। তবে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলে এটি পুরোপুরি ইউক্রেনের মালিকানায় চলে যায়। তবে ইউক্রেন কিন্তু এটিকে বসিয়ে না রেখে তাদের নিজস্ব প্রযুক্তিগত সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে গত ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সচল রাখতে সক্ষম হয়। তবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে এটি ধ্বংস হয়ে গেলেও ইউক্রেন সরকার এটিকে আবারো নতুন করে তৈরি করতে চায়। যা পুনর্নির্মাণ করতে হয়ত ব্যয় হতে পারে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার।
যদিও প্রাথমিকভাবে এটিকে আসলে মহাকাশ গবেষণায় ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছিল। বিশেষ করে গৌরব ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এএন-২২৫ 'ম্রিয়া' (Mriya) কার্গো এয়ারক্রাফটটিকে ১৯৮৮ সাল থেকে কোল্ড ওয়ারের শেষ অর্থাৎ ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের স্পেস প্রোগ্রামের জন্য বুরান ক্লাসের অরবিটার স্পেস স্যাটল পরিবহনের প্রধান আকাশ যান হিসেবে ব্যবহার হয়। তবে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলে ইউক্রেনের মালিকানায় এটিকে শুধু পণ্য পরিবহণের এক বিশাল আকারের কার্গো বিমান হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
আকাশে সাবলীলভাবে উড্ডয়ন এবং শক্তি উৎপাদনের এই কার্গো বিমানে অত্যন্ত শক্তিশালী ৬টি ডি-১৮ টার্বোফ্যান (Ivchenko Progress D-18T turbofans) জেট ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া এর শক্তিশালী প্রতিটি ইঞ্জিন ২২৯.৫ কিলোনিউটন (কেএন) থ্রাস্ট/শক্তি উৎপন্ন করতে পারে। এর ফুয়েল ক্যাপাসিটি প্রায় ৩০০ টন এবং এটি একবার ফুয়েল নিয়ে একটানা ১৫ হাজার ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত (ম্যাক্সিমাম অপারেশনাল রেঞ্জ) আকাশে ভ্রমণ করতে পারে। যদিও অবশ্য কার্গোটি ২০০ টন পে-লোড নিয়ে সর্বোচ্চ ৪ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত উড়ে যেতে পারে।
তাছাড়া খালি অবস্থায় এই আইকনিক হেভি কার্গো বিমানের নিজের ওজন ছিল কিনা ২৮৫ টন। তাছাড়া এর সর্বোচ্চ পে-লোড ক্যাপাসিটি ৬৪০ টন বলা হলেও এটি বাস্তবে রেকর্ড পরিমাণ ২৫০ টন ওজনের পে-লোড নিয়ে আকাশে উড্ডয়ন করেছিল। প্রায় ৫তলা উঁচু বিল্ডিং এর সমান এই এয়ারক্রাফটে ব্যবহার করা হয় ৩২টি চাকা। আর এই বিমানের দৈর্ঘ্য ২৭৫ ফুট ৭ ইঞ্চি, উচ্চতা ৫৯ ফুট ৫ ইঞ্চি। এর ডানার একপাশ থেকে অন্যপাশের মাপ ২৯০ ফুট। সর্বোচ্চ গতি প্রতি ঘণ্টায় ৮৫০ কিলোমিটার এবং ক্রুইজ স্পিড প্রতি ঘণ্টায় ৮০০ কিলোমিটার।
সার্ভিসে থাকা অবস্থায় ইউক্রেনের এই স্ট্র্যাটিজিক এএন-২২৫ 'ম্রিয়া' (Mriya) কার্গো বিমানটি কিন্তু বাংলাদেশে দুইবার অবতরণ করেছিল। রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের মুখে এটি ধ্বংস হয়ে গেলেও এই সুপার জায়ান্ট কার্গো এয়ারক্রাফটের জটিল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিশাল আকারের কারণে এভিয়েশন প্রযুক্তির ইতিহাসে এক অভাবনীয় উদ্ভাবন এবং বিস্ময়কর আবিষ্কার হিসেবে থেকে যাবে। আজ এক বিংশ শতাব্দীতে গ্লোবাল এভিয়েশন টেকনোলজি এক অনন্য উচ্চতায় উঠে গেলেও সেই নব্বইয়ের দশকে তৈরি পুরোনো এই কার্গো এয়ারক্রাফটের বিশালতার কাছে সবকিছু যেন ম্লান হয়ে যায়।
তথ্যসূত্র: সিএনএন, সিম্পল ফ্লাইং, ফ্লাইট লাইন, উইকিপিডিয়া।