বিকশিত হচ্ছে মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন!
বিজ্ঞান মানেই চিন্তার ইতিবাচক পরিবর্তন এবং মানব জাতির কল্যাণে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে যুগের পর যুগ এগিয়ে যাওয়া। আজ যে ধারণা বিজ্ঞানের ভাষায় সঠিক বলে মনে হচ্ছে, তা ভবিষ্যতের উচ্চ প্রযুক্তির ছোঁয়ায় হয়ত মূল ধারণাটি একেবারেই বদলে যেতে পারে। এ নিয়ে অহেতুক সমালোচনা কিংবা উপহাস করার কোনো সুযোগ নেই। বিজ্ঞান একটি ধারাবাহিক এবং চলমান প্রক্রিয়া এবং মানবজাতি টিকে থাকলে শতবর্ষ ব্যাপী এর বিবর্তন, পরিবর্তন এবং চরম মাত্রায় আধুনিকায়ন চলতেই থাকবে।
আসলে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ১৯২২ সালে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে অনুমান করেছিলেন যে, আমাদের এই মহাবিশ্বের আকার বা বিস্তৃতি হতে পারে ১ লক্ষ থেকে ৫ লক্ষ আলোকবর্ষ পর্যন্ত। অথচ তার ঠিক মাত্র ১০০ বছর পর একবিংশ শতাব্দীতে এসে ২০২৪ সালে বিজ্ঞানীরা উচ্চ প্রযুক্তির হাবল, ইউক্লিড কিংবা জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ব্যবহারের কল্যাণে মহাবিশ্বের আকার সম্পর্কে নতুন নতুন চমকপ্রদ তথ্য উপাত্ত বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করতে থাকেন।
দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণের ফলে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা বর্তমানে মনে করেন যে, সুবিশাল এই মহাবিশ্বের আকার বা আনুমানিক বিস্তৃতি হতে পারে প্রায় ৯৩ বিলিয়ন লাইট ইয়ার বা তারও বেশি। আবার আগামী ১০০ বছর পর ২১২৪ সালের দিকে এই ধারণা বদলে গিয়ে বিজ্ঞানীরা হয়ত বলবেন অসীম রহস্যে ঘেরা আমাদের এই মহাবিশ্বের আকার হবে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন লাইট ইয়ার। যা বিজ্ঞানের একটি দীর্ঘমেয়াদি, ধারাবাহিক ও চলমান প্রক্রিয়া। এমনকি বিংশ শতাব্দীর শুরুতে চিরচেনা মিল্কী ওয়ে গ্যালাক্সির পার্শ্ববর্তী অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিকে ভুল করে বিজ্ঞানীরা একটি সুবিশাল আকারের নেবুলা বা নীহারিকা বলে চিহ্নিত করেছিলেন।
তবে আজ উচ্চ প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আমরা জানি যে, আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের ব্যাস হতে পারে আনুমানিক ৮৪ হাজার ৭০০ লাইট ইয়ার থেকে ১ লক্ষ লাইট ইয়ার। যেখানে কিনা আমাদের পার্শ্ববর্তী অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির ব্যাস হতে পারে আনুমানিক ১.৫৬ লক্ষ লাইট ইয়ার দূরত্বের সমান। আর সারা মহাবিশ্বে এ রকম লক্ষ লক্ষ ছায়াপথ ছড়িয়ে রয়েছে এবং বিগ ব্যাঙের থিওরি মোতাবেক নিজের গতিতে ও সুশৃঙ্খলভাবে মহাবিশ্বের অসীম মহাশূন্যে নিজের অদৃশ্য কক্ষপথে ছুটে বেড়াচ্ছে।
আবার জ্যোর্তির্বিজ্ঞা্নীরা নিবিড়ভাবে গবেষণা করে দেখেছেন যে, মিল্কী ওয়ে এবং অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২০০ কিলোমিটার গতিতে একে অপরের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। যা আগামী প্রায় ৩ থেকে ৫ বিলিয়ন বছর পর এই দুই গ্যালাক্সি মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ব্যাপী ভয়ংকর সংঘর্ষ কিংবা মহা মিলনের মাধ্যমে এক নতুন সুপার জায়ান্ট গ্যালাক্সি গঠন করবে। তাঁরা যার নাম দিয়েছেন মিল্কো-মিডা গ্যালাক্সি এবং এর আকার বা ব্যাস হবে হয়ত আনুমানিক ৩ লক্ষ লাইট ইয়ারের সমান।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, কিছু মহাকাশ বিজ্ঞানী মনে করেন যে, এই দুই প্রতিবেশী ছায়াপথের মধ্যে প্রাথমিকভাবে মহামিলনের প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। বিশেষ করে তাঁরা পর্যবেক্ষণ করে এমন কিছু হাইপারভেলোসিটি স্টার সিস্টেম খুঁজে পেয়েছেন, যেগুলো কিনা প্রতি ঘণ্টায় ৬০ লক্ষ থেকে ৮০ লক্ষ কিলোমিটার গতিতে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি থেকে আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথে প্রবেশ করতে যাচ্ছে কিংবা অজানা সংখ্যক হাইপারভেলোসিটি স্টার ইতোমধ্যেই হয়ত প্রবেশ করেই ফেলেছে। যদিও অনেক বিজ্ঞানী নতুন এই তথ্যের সাথে পুরোপুরি একমত হতে পারেননি এবং যুক্তিসঙ্গত কারণেই এই থিউরি হয়ত সঠিক নাও হতে পারে।
তবে যা হোক না কেন, অপার বিস্ময়ে ভরা এই সুবিশাল মহাবিশ্ব হয়ত আজীবন মানবজাতির জন্য এক অতি রহস্যময় ও আকর্ষণীয় বিষয় হিসেবে থেকে যাবে। সে পর্যন্ত আমাদের প্রজন্মের কেউ হয়ত আর বেঁচেই থাকবে না। তবে সবশেষে আমাদের প্রত্যাশা হলো যে, নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন যেন প্রাণঘাতী অস্ত্র উৎপাদনে নয়, বরং মানবজাতির কল্যাণে ব্যবহার করা হয়। তা না হলে আমরা কখনই টিকে থাকতে পারব না কিংবা টাইপ টু সিভিলাইজেশনের পর্যায়ে পৌঁছাতে পারব না।
বর্তমানে মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় আমেরিকার পাশাপাশি চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো সাবলীলভাবে এগিয়ে গেলেও ১.৮ বিলিয়ন জনসংখ্যার মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর মহাকাশ জয় যাত্রায় সাবলীল অংশগ্রহণ এবং অবদান এক রকম নেই বললেই চলে। সারা বিশ্বে ৬০টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থাকলেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে এ দেশগুলো আজ অব্ধি নিজের কোনো যোগ্য স্থান করে নিতে পারেনি। তাই আধুনিক যুগের নতুন নতুন সিস্টেম উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জনের বিষয়টি বিবেচনা করলে, মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর অবদান এবং সক্ষমতা হতাশাজনক পর্যায়ে রয়ে গেছে।
যদিও অতি সাম্প্রতিক সময়ে একেবারে মুসলিম বিশ্বের বেশ কিছু দেশ যেমন তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং প্রযুক্তির একাধিক সেক্টরে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। তবে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশেষ করে মহাকাশ বিজ্ঞান ও গবেষণায় উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের আরো অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। আর এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমাদের অবশ্যই সবার আগে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বিশেষ করে বাস্তব জীবন ভিত্তিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর একটি আধুনিক ও বিশ্ব মানের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং আধুনিক কিংবা বিশ্ব মানের গবেষণার ক্ষেত্র গড়ে তোলার আর বিকল্প কিছুই হতে পারে না।
সিরাজুর রহমান, (Sherazur Rahman), শিক্ষক ও লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ।