চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এবং পরিবর্তনশীল বিশ্ব ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত হতে চাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা!
বর্তমানে আমাদের সাধারণ দৃষ্টিতে কোন কলেজ থেকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী দেশ সেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, কুয়েট, রুয়েট মেডিকেল ও অন্যান্য পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাওয়াকেই শুধু ডেডিকেটেড কিংবা বিশ্ব মানের কলেজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যা কিনা বাস্তবে একটি ত্রুটিপূর্ণ চিন্তা ও মন মানসিকতা ব্যতীত আর কিছুই হতে পারে না। এখানে আমাদের দেশ খ্যাত নটরডেম কলেজের মতো কিছু সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উন্নত বিশ্বের আদলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হলেও সার্বিকভাবে আমরা আজও সারা দেশ ব্যাপী তা কিন্তু ছড়িয়ে দিতে পারিনি।
আসলে আমাদের সকলের বোঝা উচিত, ভালো মানের একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি যে কলেজে সীমিত পরিসরে হলেও নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, গবেষণা এবং ইনোভেটিভ আইডিয়ার অ্যাপ্লাই করার উপযোগী শিক্ষার্থী গড়ে তোলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয় সেটিই হচ্ছে কিন্তু বাস্তবে একটি ডেডিকেটেড এবং বিশ্ব মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেখানে টেকসই একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি শুধু লোক দেখানো প্রদর্শনী বা কাজ না করে বাস্তবে দেশ ও জাতিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে সহায়তা করার উপযোগী একটি ইতিবাচক প্রযুক্তি, বিজ্ঞানমনস্ক এবং পরিশ্রমী প্রজন্ম গড়ে তোলা হয়। যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজ যোগ্যতায় এক বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
এখানে প্রকাশ যোগ্য যে, উন্নত পশ্চিমা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এবং তাদের অনুসরণ করে হলেও কিন্তু চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুরের মতো দেশ ষাট ও সত্তরের দশকেই পরিকল্পিতভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বান্ধব শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। তারা কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একেবারে শূন্য হাতেই ও প্রতিকূল পরিবেশে থেকেই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই তাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর এক বাস্তবমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলে। যাকে কাজে লাগিয়ে আজ প্রাচ্যের এই দেশগুলো বাস্তবে অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। সে দিক থেকে আমরা কিন্তু হতাশাজনকভাবে এখনো পর্যন্ত অনেকটাই পেছনে পড়ে রয়েছি।
তবে অনেকটা দেড়ি হয়ে গেলেও আমাদের নতুন প্রজন্মকে কাজে লাগিয়ে এক বিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক অবিশ্বাস্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যা আমাদের অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। তাই এখন শুধু পশ্চিমা নয় প্রাচ্যের চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম এবং সিঙ্গাপুরের মতো দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আংশিক অনুসরণ এবং নিজস্ব চিন্তা ধারার এবং আর্থ সামাজিক পরিবেশের আলোকে আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যায়ক্রমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা দেশের সকল স্তরেই পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন শুরু করতে পারি।
আমরা অনেকে মনে করি যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, গবেষণা, ইনোভেটিভ আইডিয়া অ্যাপ্লাই শুধু দেশের উচ্চস্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু হয়। আসলে বিষয়টি কিন্তু তা মোটেও নয়। আমাদের দেশের একেবারে প্রাথমিক শিক্ষা-স্তর থেকেই শিক্ষার্থীর মনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের চিন্তা তার বয়স ও যোগ্যতা অনুযায়ী অ্যাপ্লাই করতে হবে। দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা-স্তরে যদি শিক্ষার্থীদের নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন, গবেষণা এবং ইনোভেটিভ আইডিয়ার প্রতি প্রবল আগ্রহী কিংবা বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলা সম্ভব না হলে পরবর্তীতে দেশ ও জাতিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে তাদের দ্বারা নতুন কিছু সৃষ্টি কিংবা ভালো স্কিল আশা করার কোন সুযোগ থাকে না।
আসলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সাথে তাল মিলিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সারা বিশ্বে উচ্চ প্রযুক্তির রোবটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) প্রযুক্তির এক অভাবনীয় উত্থান শুরু হয়েছে। যার চীন, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, আমেরিকা এবং ভারতের মতো দেশগুলো বর্তমানে তুলনামূলক কম কর্মী নিয়োগ করেও শিল্প উৎপাদন সক্ষমতা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করেছে কিংবা সেই পথে হাঁটছে। আর এর বিরূপ প্রভাব এখন কিন্তু সরাসরি শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে ফুটে উঠতে শুরু করেছে। তার সাথে অদূর ভবিষ্যতে সারা বিশ্বেই অদক্ষ প্রবাসী কর্মীর চাহিদা কিন্তু আবশ্যিকভাবে অনেকটাই হ্রাস পেতে পারে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বেই অনেক সাধারণ ও জটিল কাজ মানুষকে দিয়ে না করিয়ে কিংবা কর্মী হ্রাস করে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তি সমৃদ্ধ রোবট এবং সফটওয়্যার সিস্টেম দ্বারা খুব দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
তবে যাই হোক না কেন, সারা বিশ্বেই প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও বিপ্লবের সাথে তাল মিলিয়ে ম্যানুফ্যাকচারিং এবং সার্ভিস সেক্টরে অতি দক্ষ ও যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষার্থী কিংবা কর্মীদের জন্য এক নতুন দুয়ার উন্মোচন হয়েছে কিংবা হতে যাচ্ছে। আর আগামী ২০৩০ সালের পরবর্তী সময়ের সেই বৈশ্বিক ও নিজ দেশের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিবিদ ও দক্ষ কর্মীর চাহিদার কথা মাথায় রেখে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিকল্পিতভাবে আরও আধুনিক, প্রযুক্তি নির্ভর এবং একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন এবং তা পর্যায়ক্রমে সারা দেশ ব্যাপী বাস্তবায়ন করা উচিত।