মহাবিশ্বে পানি সৃষ্টির রহস্য উদঘাটনে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা!
মহাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বিলিয়ন বিলিয়ন গ্রহের মধ্যে কোন কোথাও জটিল প্রাণের অস্তিত্ব টিকে থাকতে হলে সর্ব প্রথম গ্রহটিকে তার হোস্ট নক্ষত্রের একবারে হ্যেবিটেবল বা গ্রিন জোনে থাকার পাশাপাশি সেখানে অবশ্যই লিকুইড ফর্মে বিপুল পরিমাণ পানির অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকতে হবে। মোট কথা পানি ব্যতীত আপাতত কোথায় প্রাণের অস্তিত্ব বিকশিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ মেয়াদি গবেষণায় নিশ্চিত হয়েছেন যে, আমাদের পৃথিবীর বুকে প্রাণের প্রথম সৃষ্টি হয়েছিল মহাসাগরের জল থেকে।
বিশেষ করে জটিল পৃথিবীতে সবার আগে এককোষী জীবের সৃষ্টি হয় সাগর ও মহাসাগরের বুকে। আবার পৃথিবী সৃষ্টির সাথে সাথেই যে বিপুল পরিমাণ পানি চলে এসেছিল বিষয়টি তা কিন্তু মোটেও নয়। বরং আজ থেকে প্রায় ৪.৫৪৩ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী সৃষ্টি হলেও আনুমানিক ৪০০ কোটি বছর আগে থেকে জলীয় কণা সমৃদ্ধ কোটি কোটি গ্রহাণু ও উল্কাপিণ্ড পতনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সুবিশাল জলরাশি গড়ে উঠে পৃথিবীতে। আর সেখানে হয়ত জটিল প্রাণের বিকাশ শুরু হয় আনুমানিক ৩০০ কোটি বছর বা তারও আগে।
বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ব্যাপী গবেষণা করে দেখেছে যে, আমাদের এই বাসযোগ্য পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম দিকে প্রাণের জটিল বিকাশ ও উৎপত্তি কিন্তু পৃথিবীর মহাসাগরকে কেন্দ্র করেই বিকোশিত হতে থাকে। যদিও হয়ত সেটি ছিল একেবারেই অতি ক্ষুদ্র এককোষী ব্যাকটেরিয়া বা তারও ছোট আকারের কিছু হতে পারে। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে প্রাচীন ৩৫০ কোটি বছর আগের প্রাণের সবচেয়ে পুরোনো জীবাশ্মের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। অথচ যেখানে কিনা পৃথিবীর বুকে অতি উন্নত ডাইনোসর জাতীয় প্রাণীর উৎপত্তি শুরু হয় মাত্র প্রায় ২৫ কোটি বছর আগে।
মোট কথা বর্তমানে আমরা যে পানি পান করি এবং বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করি তা কিন্তু নিশ্চিতভাবেই আনুমানিক ৩৫০ কোটি থেকে ৩৮০ কোটি বছর আগেই সৃষ্টি হয়েছে। যা মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ব্যাপী চলা জলীয় কণা সমৃদ্ধ উল্কা পতন, শত শত বছরব্যাপী চলা বৃষ্টিপাত এবং চলমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই পৃথিবীর বুকে সুবিশাল সাগর ও মহাসাগরের সৃষ্টি করেছে। মোট কথা আমাদের সোলার সিস্টেমের একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহ পৃথিবীতে পানি বা জলীয় কণা বয়ে নিয়ে আনার জন্য উল্কাকেই চিহ্নিত করেন বিজ্ঞানীরা।
আমরা হয়ত অনেকেই মনে করে থাকি শুধু আমাদের এই পৃথিবীতেই বিপুল পরিমাণ পানির অস্তিত্ব বিদ্যমান রয়েছে। তবে বিষয়টি কিন্তু মোটেও সে রকম নয়।আসলে ২০০৭-০৮ সালের দিকে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা শক্তিশালী টেলিস্কোপের সাহায্যে এই সুবিশাল ও রহস্যময় মহাবিশ্বের এক অতীব দূরবর্তী স্থানে সুপার জায়ান্ট ব্লাক-হোল এ অবস্থান করা এক কোয়াসারের ভিতর এক বিশাল পানির ভাণ্ডার আবিষ্কার করেন। যা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে রীতিমতো ব্যাপক সারা পরে যায়। তাঁরা এখনো পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে নিবিড়ভাবে গবেষণা করে যাচ্ছেন।
আমেরিকার ম্যাট ব্রাডফোর্ডের নেতৃত্বে (জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরি) ক্যালিফোর্নিয়ার টেকনোলজি ইন্সটিটিউটের একদল গবেষক আমাদের পৃথিবী থেকে ১২.৪ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরত্বে এপিএম ০৮২৭৯+৫২৫৫ নামে পরিচিত একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের এক কোয়াসার পর্যবেক্ষণকালে এখানে বিপুল পরিমাণ জলীয় বাষ্পের আকারে মজুত থাকা পানির আধার খুঁজে পান। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই অতি উজ্জ্বল কোয়াসারের মাঝে থাকা ব্লাকহোলের ভর হতে পারে অবিশ্বাস্যভাবে সূর্য অপেক্ষা আনুমানিক ২০ বিলিয়ন গুণ বেশি।
তাছাড়া বিজ্ঞানীদের মতে, এপিএম ০৮২৭৯+৫২৫৫ নামক কোয়াসার হচ্ছে কিনা মহাবিশ্বে মজুত থাকা একক কোন স্থানে সবচেয়ে বেশি পানির ভাণ্ডার। তাছাড়া সূর্যের চেয়ে প্রায় ১ লক্ষ গুণ বড় আকারের এই কোয়াসারে মজুত থাকা জলীয় বাষ্প বা পানির পরিমাণ হতে পারে আনুমানিক পৃথিবীর সব মহাসাগরের সম্মিলিত পানির চেয়ে কমপক্ষে আনুমানিক ১৪০ ট্রিলিয়ন গুণ বেশি পানি। যদিও শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে খুঁজে পাওয়া এই রহস্যময় স্থান নিয়ে বিজ্ঞানীরা যে তথ্য উপাত্ত প্রকাশ করছেন তা কিন্তু একটি আনুমানিক তাত্ত্বিক ধারণা বা প্রেডিকশন।
তাছাড়া বিজ্ঞানীরা বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী ব্যাপী নিবিড় গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ করে দেখেন যে, আমাদের চিরচেনা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেও কিন্তু বিপুল পরিমাণ পানি বা জলীয় বাষ্পের ভাণ্ডার রয়েছে। তবে এর মোট পরিমাণ হতে পারে এই কোয়াসারের তুলনায় আনুমানিক প্রায় ৪ হাজার গুণ কম। তার মূল কারণ হচ্ছে এই মিল্কিওয়ের বেশিরভাগ পানি কিংবা জলীয় কণা কিন্তু হিম শীতল বরফে জমাট বাধা অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। যা থেকে হয়ত কোটি কোটি গ্রহের মধ্যে কিছুসংখ্যক গ্রহে নতুন জটিল প্রাণের সৃষ্টি করতে পারে বলে বিশ্বাস করেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা।
তথ্যসূত্র: জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরি, নাসা, ইউকিপিডিয়া।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman), শিক্ষক এবং লেখক, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com