কোটা আন্দোলনের শেষ দিকে একটা বাক্য ফেইসবুকে খুব ছড়িয়েছিল 'টাইটানিক নিয়ে অহংকার করাতে টাইটানিক ডুবে গিয়েছিল'। আসলেই কি অহংকার করা হয়েছিল ?
১৯০৯ সালের ৩১ মার্চ আয়ারল্যান্ডের রাজধানী বিলফাস্টে হার্ল্যান্ড অ্যান্ড উলফ জাহাজ নির্মাণ কোম্পানির ৪০১ নম্বর ইয়ার্ডে নির্মাণাধীন অলিম্পিক জাহাজের পাশে টাইটানিকের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয় । তিন বছর পর নির্মাণ কাজ ও পরীক্ষণ শেষে ১৯১২ সালের ১০ এপ্রিল আর.এম.এস. টাইটানিক তার প্রথম যাত্রা শুরু করে । চার দিন পর কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ডের কেইপ রেইস উপকূল থেকে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার পূর্বে এটি হিমশৈলের সাথে ধাক্কা খেয়ে ডুবে যায় ।
কিন্তু প্রশ্ন হলো 'টাইটানিক কখনই ডুবতে পারে না' এমনটা নাকি বলা হয়েছিল বলে যে কথাগুলো শোনা যায় তা কতটুকু সত্য? আমরা অনেকই বলি এই বড়াই করার কারণেই তারা না কি শাস্তি পেয়েছে । এই প্রশ্নের উত্তর হলো, এই উক্তিটি একটি অতিকথা বা myth. জাহাজ নির্মাতা হার্ল্যান্ড অ্যান্ড উলফ এবং মালিক হোয়াইট স্টার লাইন থেকে এমন কোনো দাবি করা হয়নি । তাহলে এটা এলো কোথা থেকে? সেই ইতিহাসে আসি ।
বিংশ শতকের শুরুতে জাহাজ নির্মাণকারী সংস্থাগুলো কে কত বড়, কত বিলাসবহুল আর কত দ্রুতগামী জাহাজ বানাতে পারে তা নিয়ে এক প্রকার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল । কার্নাড লাইনের দুই জাহাজ মরেটেইনিয়া ও লুসিটেইনিয়া তখন পৃথিবীর সবচেয়ে বিলাসবহুল, বড় ও দ্রুতগামী জাহাজ ছিল । কার্নাডকে পেছনে ফেলতে প্রতিযোগিতায় আসে হোয়াইট স্টার লাইন । শুরু হয় অলিম্পিক জাহাজের নির্মাণ কাজ । ১৯১১ সালে যখন একই সাথে অলিম্পিক ও টাইটানিক দুই জাহাজের নির্মাণ চলছিল তখন হোয়াইট স্টার লাইন জনতার উদ্দেশ্যে শিপবিল্ডার ম্যাগাজিনে প্রচারণা মূলক প্রতিবেদন ছাপায় । সেখানে জনতাকে আকর্ষণ করতে 'unsinkable' শব্দটি ব্যবহৃত হয় । অনেকটা নির্বাচনের প্রার্থীদের প্রচারণার সময় বড় বড় প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মতো ।
টাইটানিক নির্মাণ ও তাতে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ও পরিবর্তনের পর যাত্রার আগে জাহাজটিকে নিয়ে অনেক প্রতিবেদন ছাপানো হয় । গঠনশৈলী বিশেষ করে জাহাজের সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হয় । জাহাজের ১৬ টি জলরোধী কুঠুরি (watertight conpartments) নিয়ে আলোচনা করা হয় । বেশ কিছু প্রতিবেদন 'practically unsinkable' বা 'তাত্ত্বিকভাবে অনিমজ্জনীয়' বলে উপসংহার টানে । গণমাধ্যমে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ নিজের সাক্ষাৎকারে টাইটানিক নিয়ে বলতে গিয়ে এই শব্দের প্রয়োগ করেন । গণমাধ্যমসহ এই সব প্রচার প্রচারণায় জনতার কাছে টাইটানিক অনিমজ্জনীয় হয়ে দাঁড়ায় ।
বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা জানান ধাক্কা লাগার পরেও অনেক যাত্রী শান্ত ছিলেন কারণ তাঁরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিলেন যে টাইটানিক কোনোদিন ডুববে না । হোয়াইট স্টার লাইনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাংকলিন ১৫ এপ্রিল সকালে মানে টাইটানিক ডুবে যাবার পর বলেন 'টাইটানিকের সাথে আমাদের যোগাযোগ বন্ধ হয়েছে, তবে আমরা আশাবাদী যে জাহাজটি অনিমজ্জনীয় । খারাপ আবহাওয়া বা এরকম কোনো কারণে হয়তো রেডিও সিগনাল পাওয়া যাচ্ছে না । খবর পেয়েছি জাহাজটি সামনের দিকে কয়েক ফুট পানির নিচে চলে গেছে । সামনে অংশে পানি ভরায় এমন হয়েছে । কিন্তু জলরোধী কুঠুরিগুলো কয়েক ফুট ডুবলেও ভেসে থাকতে সক্ষম ।' তিনিও যে এই অতিকথা বিশ্বাস করেছিলেন তা বোঝা যায় । দুর্ঘটনার পর এই অতিকথাটি আরও তীব্র হয়ে ওঠে ।
এই ঘটনার সাথে সৃষ্টিকর্তার যে ব্যাপারটা আনা হয় যে 'সৃষ্টিকর্তাও তাকে ডোবাতে পারবে না' এটাও সত্য নয় । এটা জেমস ক্যামেরনের বিখ্যাত টাইটানিক চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত সামান্য সংলাপ । তাই এটা সত্য যে মানুষজন আসলেই বিশ্বাস করেছিল যে টাইটানিক অনিমজ্জনীয় কিন্তু এই ব্যাপারে কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল না ।
লেখক
রাশিক আজমাইন