বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সুপার কম্পিউটারের আদ্যোপান্ত!
একবিংশ শতাব্দীর উচ্চ পর্যায়ের বৈজ্ঞানিক ও জটিল গবেষণামূলক কাজে বর্তমানে সুপার কম্পিউটার প্রযুক্তি এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। বর্তমানে বিশ্বের উচ্চ প্রযুক্তি সমৃদ্ধ দেশগুলোর মহাকাশ গবেষণা, মেডিকেল সায়েন্স, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, এভিয়েশন এন্ড রোবোটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং রোআবহাওয়ার পূর্বাভাস, জলবায়ু গবেষণা, তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান, আণবিক মডেলিং (কাঠামো এবং বৈশিষ্ট্যগুলি গণনা করা) সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) প্রযুক্তি সমৃদ্ধ সুপার কম্পিউটার।
আসলে সুপার কম্পিউটারের প্রাথমিক ব্যবহার গত ১৯৬৪ সালে প্রথম শুরু হলেও একেবারে প্রথম প্রোগ্রামেবল এন্ড ডিজিটালাইজড কম্পিউটার হচ্ছে কিন্তু ইনিয়াক বা ENIAC ( Electronic Numerical Integrator And Computer)। এটিকে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৪৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারিতে স্থাপন করা হয়। যা ডিজাইন ও তৈরি করতে তৎকালীন মার্কিন সরকার প্রায় ৫ লক্ষ ডলার ব্যয় করেছিল। আসলে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে আমেরিকা কিন্তু বিশ্বের যে কোন দেশকে কমপক্ষে ৫০ বছর পেছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও উচ্চ প্রযুক্তির সুপার কম্পিউটার নিয়ে গবেষণা করে জার্মান ভিত্তিক টপ৫০০ নামক একটি থিংক ট্যাংক বা সংস্থা। চলতি ২০২৪ সালের জুন মাসে তাঁদের টপ৫০০ ওয়েবসাইটে বিশ্বের সেরা উচ্চ প্রযুক্তির এবং সবচেয়ে শক্তিশালী ৫০০টি সুপার কম্পিউটারের র্যাংকিং প্রকাশ করে। সংস্থাটি মূলত গত ১৯৯৩ সাল থেকে নিয়মিতভাবে প্রতি বছর দুই বার (জুন এবং নভেম্বর মাসে) গ্লোবাল টপ হাইস্পিড সুপার কম্পিউটারের হালনাগাদ র্যাংকিং বা তালিকা প্রকাশ করে আসছে।
টপ-৫০০ ওয়েবসাইটের হালনাগাদ (৬৩ তম এডিশন) তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বের সেরা ও সবচেয়ে শক্তিশালী সুপার কম্পিউটার হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'ফ্রন্টিয়ার' সুপার কম্পিউটার। তাছাড়া বিশ্বের সেরা ১০টি সুপার কম্পিউটারের র্যাংকিং এ আমেরিকার মোট ৫টি, জাপানের ১টি, ফিনল্যান্ডের ১টি, সুইজারল্যান্ডের ১টি, ইতালির ১টি এবং স্পেনের ১টি করে উচ্চ প্রযুক্তির হাইস্পিড সুপার কম্পিউটার স্থান করে নিয়েছে। গত ২০২৩ সালের তালিকায় বিশ্বের সেরা ১০টি সুপার কম্পিউটারের তালিকায় চীনের দুইটি সুপার কম্পিউটার স্থান করে নিলেও চলতি ২০২৪ সালের ৬৩ তম এডিশনে সেরা দশের তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়।
গত ২০২২ সাল থেকে চলতি ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত, বিশ্বের সেরা ও শীর্ষ স্থানীয় এক নম্বর সুপার কম্পিউটার হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'ফ্রন্টিয়ার' হাইলি অ্যাডভান্স সুপার কম্পিউটিং সিস্টেম। মূলত আমেরিকার Hewlett Packard Enterprise (এইচপি) কোম্পানির তৈরি নতুন প্রজন্মের 'ফ্রন্টিয়ার' অ্যাডভান্স কম্পিউটিং সিস্টেম বা সুপার কম্পিউটারের গতি হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে (Rpeak) রেট ১,৭১৪.৮১ পেটাফ্লপ (এফএলওপিএস) বা floating point operations per second (FLOPS)।
হাইলি অ্যাডভান্স 'ফ্রন্টিয়ার' সুপার কম্পিউটিং সিস্টেম এখনো পর্যন্ত নিখুঁতভাবে প্রতি সেকেন্ডে ১.১ কুইন্টিলিয়ন হিসাবের মাইলফলক অর্জন করে রেখেছে। এটিকে আমেরিকার ওক রিজ ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির (ওআরএনএল)-তে স্থাপন করা হয়েছে। এই সুপার কম্পিউটারের মোট কোরের সংখ্যা হচ্ছে ৮,৬৯৯,৯০৪টি। এতে ব্যবহৃত হয়েছে এএমডি অপ্টিমাইজড থার্ড জেনারেশন (ইপিওয়াইসি) ৬৪সি ২জিএইচজেড প্রসেসর।
৬৮০ বর্গমিটার এরিয়া ব্যাপী বিস্তৃত এই সুপার কম্পিউটার স্থাপনে মোট ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন থেকে ৭০০ মিলিয়ন ডলার। এর সকল উচ্চ প্রযুক্তির পার্টস, ডিভাইস এন্ড কিটস মোট ৭৪টি কেবিনে স্থাপন করা হয়েছে এবং প্রতিটি কেবিনের ওজন প্রায় ৪ টন। এই সুপার কম্পিউটারটি গত ২০২১ সালে স্থাপন করা হলেও কার্যকরভাবে ব্যবহার করা শুরু হয় গত ২০২২ সালের মে মাস থেকে। এটি সার্বিকভাবে পরিচালনায় প্রায় ২২.৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়।
গত ২০২২ সালের জুন মাসের আগে পর্যন্ত বিশ্বের সেরা ও সবচেয়ে শক্তিশালী সুপার কম্পিউটার ছিল জাপানের হাইলি অ্যাডভান্স 'ফুকাগু' সুপার কম্পিউটার৷ যাকে প্রযুক্তিগত সক্ষমতায় সক্ষমতায় গত ২০২২ সালের জুন মাসে পিছনে ফেলে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সুপার কম্পিউটিং সিস্টেম হিসেবে নিজের যোগ্য স্থান করে নেয় আমেরিকার তৈরি 'ফ্রন্টিয়ার' সুপার কম্পিউটার। হালনাগাদকৃত এই টপ৫০০ তালিকায় আমেরিকার মোট ১৭১টি, চীনের ৮০ এবং জার্মানির ৪০টি এবং জাপানের মোট ২৯টি সুপার কম্পিউটার স্থান করে নিয়েছে।
তবে ২০২৪ সালের জুন মাসের টপ-৫০০ তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা আমেরিকার তৈরি আরোরা সুপার কম্পিউটারের গতি হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে (Rpeak) রেট ১,৯৮০.০১ পেটাফ্লপ (এফএলওপিএস) এবং এর মোট কোরের সংখ্যা ৯২,৪৬,১২৮টি। এটি ডিজাইন ও তৈরি করেছে আমেরিকার এইচপিই টেক জায়ান্ট কর্পোরেশন। তাছাড়া আমেরিকার বিখ্যাত মাইক্রোসফট কর্পোরেশন তৈরি করেছে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ স্থানীয় সুপার কম্পিউটার "ঈগল"। এর গতি হলো প্রতি সেকেন্ডে (Rpeak) রেট ৮৪৬.৮৪ পেটাফ্লপ (এফএলওপিএস) এবং মোট কোরের সংখ্যা ২০,৭৩,৬০০টি।
এবার চতুর্থস্থানে রয়েছে জাপানের ‘ফুজিতসু’ কোম্পানির তৈরি সুপার কম্পিউটার ‘ফুকাগু’। এর ডাটা কম্পিউটিং স্পিড রেট ৫৩৭.২১ পেটা ফ্লপ (এফএলওপিএস)। যেটি জাপান গত ২০২০ সালে তৈরি করে বিশ্বের সামনে উন্মোচন করে। তাছাড়া এই এলিট তালিকায় পঞ্চম স্থানে থাকা ফিনল্যান্ডের এইচপিই কোম্পানি গত ২০২৩ সালে উন্মোচন কারে সুপার ফাস্ট ‘লুমি’ সুপার কম্পিউটার। যাতে ব্যবহৃত হয়েছে এএমডি অপ্টিমাইজড থার্ড জেনারেশন (ইপিওয়াইসি) ৬৪সি ২জিএইচজেড প্রসেসর। এর গতি বা ডাটা প্রসেসিং সক্ষমতা হচ্ছে ৪২৮.৭ পেটাফ্লপ (এফএলওপিএস)।
এদিকে ষষ্ঠ স্থানে থাকা সুইজারল্যান্ডের তৈরি আল্পস সুপার কম্পিউটারের গতি হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে (Rpeak) রেট ৩৫৩.৭৫ পেটাফ্লপ (এফএলওপিএস) এবং এর মোট কোরের সংখ্যা ১৩,০৫,৬০০টি। ইটালির তৈরি সুপার ফাস্ট কম্পিউটার ‘লিয়োনার্দো’ ৩০৪.৪৭ পেটাফ্লপ স্পিড নিয়ে তালিকায় শীর্ষ সপ্তম স্থানে রয়েছে। এটি কিন্তু গত ২০২৩ সালের শুরুর দিকে স্থাপন করা হয়।
আর এদিকে উচ্চ প্রযুক্তির সুপার ফাস্ট সুপার কম্পিউটার উদ্ভাবনের দিক দিয়ে আমেরিকার সাথে পাল্লা দিয়ে কিছুটা কম শক্তিশালী হলেও রেড জায়ান্ট চীন কিন্তু অনেকটাই এগিয়ে গেছে। চলতি ২০২৩ সালের ৬১ তম এডিশনে টপ-৫০০ তালিকায় ১৩ তম স্থানে থাকা চীনের নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি 'সানওয়ে তাইহুলাইট' সুপার কম্পিউটারের গতি ছিল প্রতি সেকেন্ডে ১২৫.৪৪ পেটাফ্লপ (এফএলওপিএস)। তাছাড়া তালিকায় ১৬ স্থানে থাকা চীনের আরেক সুপার কম্পিউটার এবং 'তাইয়ানহে-২এ' সিরিজের সুপার কম্পিউটারের গতি দেখানো হয়েছে প্রতি সেকেন্ডে ১০০.৬৮ পেটাফ্লপ (এফএলওপিএস)।
চলতি ২০২৪ সালের জুনের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের সেরা দ্রুত গতির ৫০০ সুপার কম্পিউটারের ১১০ তম সুপার কম্পিউটার হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ভারতের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি সমৃদ্ধ এআইআরএডাব্লিউএটি (AIRAWAT) সুপার কম্পিউটার। যার গতি ১৩.১৭ পেটাফ্লপ (Rpeak) এবং এর কোরের সংখ্যা ৮১,৩৪৪টি। এই সিরিজের অ্যাডভান্স সুপার কম্পিউটার মূলত ডিজাইন ও তৈরি করেছে ভারতের পুনে ভিত্তিক সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট অব অ্যাডভান্স কম্পিউটিং (সিডিএসি)।
তবে মানবজাতির ইতিহাসে প্রথম কোন হাইস্পিড সুপারকম্পিউটার ডিজাইন ও তৈরি করা হয় ১৯৬৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটির কন্ট্রোল ডাটা কর্পোরেশনের তৈরি সিডিসি-৬৬০০ সিরিজের সুপার কম্পিউটার হচ্ছে আসলে বিশ্বের প্রথম কোন সফল সুপারকম্পিউটার। এটি মূলত ডিজাইন করেন সাইমুর কেরি। সিডিসি-৬৬০০ সিরিজের সুপার কম্পিউটার তৈরিতে ৪ লক্ষ ট্রানজিস্টার এবং প্রায় ১০০ মাইলের কাছাকাছি ক্যাবল ব্যবহার করা হয়। এটি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩০ লক্ষের মতো নির্দেশাবলি প্রসেস করার উপযোগী করে ডিজাইন করা হয়েছিল। এর পার ইউনিট কষ্ট ছিল তৎকালীন সময়ে প্রায় ২.৪ মিলিয়ন ডলার। এর ডাটা প্রসেসিং ক্যাপাসিটি বা গতি ছিল প্রতি সেকেন্ডে ৩ মেগা এফএলওপিএস (megaFLOPS)।