তুরস্ক জেট ইঞ্জিন তৈরিতে এবার বড় ধরনের সফলতা পেয়েছে!
বর্তমানে এভিয়েশন সেক্টরে সবচেয়ে জটিল এবং স্পর্শকাতর প্রযুক্তি হচ্ছে জেট ইঞ্জিন ডিজাইন এন্ড ম্যানুফ্যাকচারিং। বর্তমানে সারা বিশ্বের প্রায় ১২টি থেকে ১৫টি দেশ সামরিক ও বেসামরিক এয়ারক্রাফট, হেলিকপ্টার, মিসাইল, কমব্যাট এন্ড ননকমব্যাট ড্রোন ডিজাইন ও তৈরি করলেও বাস্তবে মাত্র ৬টি দেশ একেবারে নিজস্ব প্রযুক্তির জেট ইঞ্জিন তৈরি করতে সক্ষম। যার মধ্যে রয়েছে আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন এবং ইউক্রেনের মতো দেশের নাম।
প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে সমৃদ্ধ হলেও জাপান এবং জার্মানির মতো দেশ কিন্তু একেবারে হাইলি অ্যাডভান্স জেট ইঞ্জিন ডিজাইন ও তৈরিতে এখনো পর্যন্ত সেভাবে এগিয়ে আসেনি। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জেট ইঞ্জিন চালিত প্রথম যুদ্ধবিমান আবিষ্কার বা তৈরি করে জার্মানি। তবে এবার কিন্তু সারা বিশ্বকে চমকে দিয়ে জেট ইঞ্জিন তৈরিতে নিজের নাম লিখিয়েছে তুরস্ক। আর এই গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিতে সাম্প্রতিক সময়ে নজরকাড়া সাফল্য দেখিয়েছে দেশটি।
মূলত প্রায় এক দশক আগে থেকেই তুরস্ক জেট ইঞ্জিনের জন্য পশ্চিমা বিশ্বের উপর নির্ভরতা হ্রাস করে নিজস্ব প্রযুক্তির ডেডিকেটেড ইঞ্জিন তৈরির চেষ্টা করে আসছে। যার ধারাবাহিকতায় এবার তারা নিজস্ব প্রযুক্তির বেশ কিছু সিরিজের যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টারে ব্যবহারের উপযোগী ইঞ্জিন উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। মনে করা হয় আধুনিক প্রযুক্তির যুগে এসে রকেট এবং পরমাণু বোমার চেয়েও ভালো মানের জেট ইঞ্জিন তৈরি করা অনেক কঠিন একটি কাজ।
আসলে বছর খানেক আগে রাশিয়া কঠিন শর্তের মুখে তুরস্ককে জেট ইঞ্জিন তৈরির প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে চাইলে তুরস্ক তাতে রাজি হয়নি। তারা অনেকটাই নীরবেই যুক্তরাজ্য ও ইউক্রেনের সহায়তায় নিজস্ব প্রযুক্তির টার্বোফ্যান এবং টার্বোশেফট জেট ইঞ্জিনের প্রযুক্তি অর্জনে ব্যাপকভাবে গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকে। তবে ড্রোন, মিসাইল এবং হেলিকপ্টারের উপযোগী ইঞ্জিন তৈরিতে সফলতা পেলেও যুদ্ধবিমানে ব্যবহারের উপযোগী জেট ইঞ্জিন ডিজাইনে দেশটি এখনো পর্যন্ত উন্নয়নের একেবারে প্রাথমিক স্তরে রয়েছে।
অন্যদিকে গত দুই দশক থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের জেট ইঞ্জিনের ক্লোন কপি করে কিংবা প্রযুক্তি হাতিয়ে নিয়ে হলেও চীন তার নিজস্ব প্রযুক্তির কিছুটা নিম্ন মানের বা সিরিজের ডাব্লিউএস-১০/১৩/১৫ সিরিজের ইঞ্জিন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। আর চীন এখন পর্যন্ত উচ্চ প্রযুক্তির জেট ইঞ্জিন ডিজাইন ও আধুনিকায়নে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে। এদিকে কয়েক দশক থেকে ভারত নিজস্ব প্রযুক্তির জেট ইঞ্জিন তৈরির ব্যাপক চেষ্টা করে গেলেও বাস্তবে তারা এখনো পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
তুরস্কের এরদোয়ান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিগত দুই দশকে নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্প উন্নয়নে পরিকল্পিতভাবে কাজ শুরু করে। যার ধারাবাহিকতায় দেশটি সামরিক যান, ট্যাংক এবং হেলিকপ্টারে ব্যবহারের উপযোগী বেশকিছু সিরিজের ডেডিকেটেড ইঞ্জিন তৈরির কাজ শুরু করে এবং এ কাজে তারা কিন্তু ইতোমধ্যেই বড় ধরনের সফলতা পেয়েছে। এর পাশাপাশি দেশটি বর্তমানে আরও বেশকিছু মডেলের উচ্চ প্রযুক্তির ইঞ্জিন নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে উন্নয়ন ও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। যা সার্ভিসে আসতে আরো হয়ত কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে।
বর্তমানে তুরস্কের ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাবে উৎপাদিত ইঞ্জিনের মধ্যে একটি হচ্ছে ‘বিএমসি’ পাওয়ারের তৈরি ৪০০ হর্সপাওয়ারের ‘টুনা’ ইঞ্জিন। এই জাতীয় ইঞ্জিন সাধারণত সামরিক সাঁজোয়া গাড়িতে ব্যবহার করা হয়। এর পাশাপাশি বর্তমানে তার্কিস এ্যারোস্পেস কোম্পানির তৈরি পিডি-১৭০ লাইট ইঞ্জিন আনকা, আকসুঙ্গুর এবং বায়রাক্তার টিবি-৩ হাইলি অ্যাডভান্স কমব্যাট ড্রোনে ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার একই প্রতিষ্ঠানের তৈরি পিজি-৫০ সিরিজের ছোট আকারের ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয় ‘কারগু’ অটোনোমাস সুইসাইডাল ড্রোনে।
তার্কিস অ্যারোস্পেস কোম্পানির নিজস্ব ডিজাইনে তৈরি টিএস-১৪০০ সিরিজের হাইলি অ্যাডভান্স টার্বোশেফট ইঞ্জিন অতি সাম্প্রতিক সময়ে সম্প্রতি তুরস্কের ‘গোকবে’ হেলিকপ্টারে সফলভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাছাড়া তাদের তৈরি একই টার্বোশেফট ইঞ্জিন এছাড়াও অ্যাটাক হেলিকপ্টারে ব্যবহার করে বড় ধরনের সফলতা পায় দেশটি। আর দেশটি এখন একেবারে নিজস্ব প্রযুক্তির তৈরি যুদ্ধবিমানে ব্যবহারের উপযোগী ২টি সিরিজের টিএফ-৬০০০ এবং টিএফ-১০০০০ আফটার টার্বোফ্যান (প্রোটোটাইপ) ইঞ্জিন নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। যা বর্তমানে পরীক্ষামূলক পর্যায়ে থাকলেও আগামী ২০২৬ সালের দিকে হয়ত সার্ভিসে চলে আসতে পারে।
তুরস্কের আরেক ইঞ্জিন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি ‘কালে আরগে’ কোম্পানি একেবারে নিজস্ব প্রযুক্তির ক্রুজ মিসাইলে ব্যবহারের উপযোগী কেটিজি-৩২০০/৩৭০০ সিরিজের ইঞ্জিন ডিজাইন ও তৈরি করে। যা ‘এ্যাটমাকা’ এবং স্টান্ড অফ ক্রুজ মিসাইলে (এসওএম) ব্যবহার করা হয়। আবার একই কোম্পানির তৈরি কেটিজি-১৭৫০ সিরিজের জেট ইঞ্জিন ব্যবহৃত হচ্ছে শর্ট রেঞ্জের ‘চাকির’ মিসাইলে। রকেটসান কোম্পানির তৈরি ২৭৫ কেজি ওজনের ‘চাকির’ ক্রুজ মিসাইলের সর্বোচ্চ রেঞ্জ ১৫০ কিলোমিটার।
তথ্যসূত্রঃ দ্য ডেইলি সাবাহ, দ্য ইউরোএশিয়ান টাইমস, ইউকীপিডিয়া।