এক যুগান্তকারী আবিষ্কার হতে যাচ্ছে চীন তৈরি ক্ষুদ্র নিউক্লিয়ার এনার্জি ব্যাটারি!
বর্তমানে ক্ষুদ্র আকারের মোবাইল ডিজিটাল ডিভাইসে এনার্জি সাপ্লাইয়ের জন্য ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ধরনের স্বল্প সক্ষমতার রিচার্জেবল ব্যাটারি। বর্তমানে লিথিয়াম আয়ন এবং লিথিয়াম পলিমার ব্যাটারির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা গেলেও এর কিন্তু বেশকিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। আর এই সমস্যা সমাধানে লো পাওয়ার সাপ্লাই ব্যাটারির জগতে এবার এক নতুন বিপ্লব আনতে যাচ্ছে রেড জায়ান্ট চীন। চলতি ২০২৪ সালের শুরুর দিকে চীনের একটি উদীয়মান স্টার্ট-আপ ‘বেটা ভোল্ট’ কোম্পানি পরীক্ষামূলকভাবে এক অতি ক্ষুদ্র আকারের বিভি-১০০ নিউক্লিয়ার এনার্জির ব্যাটারি ডিজাইন ও তৈরি করে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
প্রতিষ্ঠানটির দেয়া তথ্যমতে, তাদের তৈরি নতুন প্রজন্মের এই (প্রোটোটাইপ) নিউক্লিয়ার সেলের ব্যাটারি এখনো পর্যন্ত গবেষণা ও উন্নয়নের একেবারে প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। তবে এটি অদূর ভবিষ্যতে ডিজিটাল ডিভাইসে স্বল্পমাত্রায় নিরবচ্ছিন্ন এনার্জি সাপ্লাইয়ের এক আদর্শ ব্যবস্থা হয়ে উঠতে পারে এটি। এই জাতীয় স্বল্প সক্ষমতার ও হালকা ওজনের ব্যাটারি সিস্টেম অতি ক্ষুদ্র আকারের ডিজিটাল ডিভাইসে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পাওয়ার সাপ্লাই করতে পারে। প্রতিষ্ঠানটির প্রযুক্তিবিদেরা মনে করেন, আগামীতে এই জাতীয় অতি ক্ষুদ্র নিউক্লিয়ার পাওয়ার স্টোরেজ টেকনোলজি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে।
চীনের 'বেটা ভোল্ট' কোম্পানি দাবি করে যে, তাদের নতুন উদ্ভাবিত এই নিউক্লিয়ার মাইক্রো ব্যাটারি কোন প্রকার চার্জ ছাড়াই নাকি একটানা কমপক্ষে ৫০ বছর নিরাপদে ডিভাইসের ব্যবহারিক সক্ষমতা অনুযায়ী এনার্জি সাপ্লাই দিয়ে যাবে। আর এটি ব্যবহারে প্রচলতি লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির মতো কোন রকম ঝুঁকি থাকবে না। আর তাদের এহেন দাবি বাস্তবে সত্য হলে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যাটারিতে বারবার চার্জিং এর ঝামেলা হয়ত অনেকটাই শেষ হয়ে যেতে পারে।
আসলে তাদের উদ্ভাবিত নতুন প্রজন্মের এই বিভি-১০০ ব্যাটারির ছোট্ট একটি মডিউলে নিকেল-৩ আইসোটোপ এবং হীরার সেমিকন্ডাক্টর উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে। অবশ্য তাদের উদ্ভাবিত পরীক্ষামূলক মাইক্রো ব্যাটারি এখনো পর্যন্ত ৩ ভোল্টের মাত্র ১০০ মাইক্রোওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম। তবে আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে কমপক্ষে ১ ওয়াটের পাওয়ার সাপ্লাই সক্ষমতার ব্যাটারি ডিজাইন ও তৈরি করার বিষয়ে প্রবলভাবে আশাবাদী তারা।
বর্তমানে নতুন প্রযুক্তির এই ক্ষুদ্র আকারের নিউক্লিয়ার সেলের বিভি-১০০ সিরিজের ব্যাটারির দৈর্ঘ্য ১৫ মিলিমিটার, প্রস্থ ১৫ মিলিমিটার এবং পুরুত্ব মাত্র ৫ মিলিমিটার। তাদের দেয়া ভাষ্যমতে, এটি মাইনাস -৬০ ডিগ্রি তাপমাত্রা থেকে সর্বোচ্চ ১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেও নিরাপদে ব্যবহার করা যাবে। তার সাথে দীর্ঘ মেয়াদি চার্জিং স্টোরেজ ক্যাপাবিলিটি থাকায় ইলেকট্রনিক ডিভাইস চার্জিং এর ক্ষেত্রে সকল ধরনের ঝামেলা কিংবা দুশ্চিন্তা মুক্ত হবে।
এই জাতীয় নিউক্লিয়ার আইসোটোপ এনার্জির ব্যাটারি অদূর ভবিষ্যতে ক্ষুদ্র আকারের মোবাইল ফোন/স্মার্টফোন ছাড়াও স্পেস ডিভাইস, এআই ডিভাইস, চিকিৎসা সরঞ্জাম, মাইক্রোপ্রসেসর, উন্নত সেন্সর, উচ্চ প্রযুক্তির রোবট কিংবা ক্ষুদ্র ড্রোনের মতো ডিভাইসে কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই নিরাপদে ব্যবহার সম্ভব হবে। আবার ব্যবহারের দিক দিয়ে এটি নাকি প্রচলিত ব্যাটারির তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর ও টেকসই হবে। তার সাথে নেই অতিরিক্ত গরম হয়ে বিস্ফোরণ কিংবা আগুন লেগে যাওয়ার মতো মারাত্মক কোন সম্ভাবনা।
এই মাইক্রো নিউক্লিয়ার এনার্জি সিস্টেম নিয়ে গবেষণারত চীনের প্রযুক্তিবিদেরা মনে করেন যে, এতে শক্তির উৎস হিসেবে নিকেল-৩ আইসোটোপ ব্যবহার করা হলেও নেই কোনো ধরনের তেজস্ক্রিয়তার ঝুঁকি। তারা উচ্চ প্রযুক্তির এই নিউক্লিয়ার এনার্জির ব্যাটারি নিয়ে এখনো পর্যন্ত গবেষণা করে গেলেও আগামী ২০২৫ সালের দিকে সীমিত পরিসরে এক ওয়াটের নিউক্লিয়ার ব্যাটারি বাণিজ্যিকভাবে ম্যানুফ্যাকচারিং করার বিষয়ে প্রবলভাবে আশাবাদী। আর ভবিষ্যতের এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তারা নাকি ইতোমধ্যেই সকল ধরনের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা যাচাই ও প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছে।
বর্তমানে এই বিভি-১০০ সিরিজের নতুন সংস্করণের পাওয়ার সাপ্লাই সক্ষমতা হবে মাত্র ১ ওয়াট। যা বাণিজ্যিকভাবে বাজারে প্রবেশ করতে আগামী ২০২৫ সালে। তবে এটা ঠিক যে, নতুন উদ্ভাবিত এই নিউক্লিয়ার পাওয়ার স্টোরেজ ডিভাইস দিয়ে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় এমন ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস চালানো কিন্তু আপাতত কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। এদিকে ‘বেটাভোল্ট’ কোম্পানি এ সমস্যা সমাধানে নতুন প্রজন্মের শক্তিশালী ও অধিক পাওয়ার জেনারেট করতে সক্ষম এমন দীর্ঘস্থায়ী ব্যাটারিতে স্ট্রন্টিয়াম-৯০, প্রমিথিয়াম-১৪৭ এবং ডিউটেরিয়ামের মতো জটিল আইসোটোপগুলো নিরাপদে ব্যবহার করা সম্ভব কিনা তা নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা করে যাচ্ছে। যদিও তাদের এহেন প্রচেষ্টা একেবারেই সফল তা কিন্তু বলার সময় এখনো হয়নি।
আসলে কোল্ড ওয়ার যুগে ষাট কিংবা সত্তরের দশকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকা মহাকাশযানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্লুটোনিয়াম ভিত্তিক আইসোটোপ সমৃদ্ধ পাওয়ার জেনারেশন সিস্টেম ইনস্টল করত। যেমন ভয়েজার-১/২ স্পেস-প্রোবে পাওয়ার জেনারেট করার জন্য রেডিওআইসোটোপ থার্মোইলেক্ট্রিক জেনারেটর (আরটিজি) ইনস্টল করা হয়। যা কিনা ক্ষয়িষ্ণু প্লুটোনিয়াম থেকে উৎপন্ন তাপকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রুপান্তর করে এখনো পর্যন্ত নিজেকে স্বল্প মাত্রায় হলেও সচল রেখেছে। তবে এই জাতীয় নিউক্লিয়ার এনার্জি সিস্টেম খুবই ব্যয়বহুল এবং তেজস্ক্রিয় ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি এর মডিউলের আকারও ছিল বেশ বড়।
তথ্যসূত্রঃ সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, নাসা, ইন্ডিপেনডেন্ট, চায়না ডেইলি।
সিরাজুর রহমান (Sherazur Rahman) সহকারী শিক্ষক ও লেখক, বিনগ্রাম উত্তরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিংড়া, নাটোর, বাংলাদেশ। sherazbd@gmail.com