সামাজিক ও পারিবারিক দায়বদ্ধতা ও মূল্যবোধ সংকটে জাপানের নতুন প্রজন্ম!
বর্তমানে সারা বিশ্বের মধ্যে উন্নত শিক্ষা এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নে জাপান অনেক দূর এগিয়ে গেছে। অনেকেই বলে থাকেন যে, আমরা বর্তমানে ২০২৪ সালে বাস করলেও জাপান কিন্তু তাদের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নাকি ২০৫০ সালের যুগে বাস করছে। তাছাড়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং মানবিক দিকের বিচারে ইতোমধ্যেই সারা বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে এই জাতি। তবে মিডিয়ায় যাই প্রচার করা হোক না কেন, জাপানের সামাজিক, পারিবারিক, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ কিন্তু নতুন প্রজন্মের চরম উদাসীনতার কারণে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে বাধ্য।
আসলে সোশ্যাল মিডিয়ায় উন্নত ও প্রযুক্তি সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে জাপানিজদের নিজস্ব প্রযুক্তির মহাকাশে স্পেস লিফট কিংবা মঙ্গলগ্রহে মহাকাশযান চালানোর যতই গল্প শোনানো হোক না কেন বাস্তবে তাদের নতুন প্রজন্মের মাঝে সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মহীনতা এবং পারিবারিক সম্পর্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নেতিবাচক প্রবণতা কিন্তু বিশ্ববাসীর নজর এড়ায়নি। নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও গবেষণায় জাপান অনেক দূর এগিয়ে গেলেও বর্তমানে প্রতি বছর গড়ে সারা বিশ্বের মধ্যে রেকর্ড সংখ্যক মানুষ দুর্ভাগ্যবশত আত্মহত্যা করেন। যার সংখ্যা কিনা গত ২০২৩ সালের হিসেব অনুযায়ী অবিশ্বাস্যভাবে প্রায় ২১ হাজারের অধিক হতে পারে।
সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়ে, হতাশায় এবং বিশেষ করে অত্যধিক কাজের চাপে দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের নাগরিকদের আত্মহত্যা এবং মৃত্যুর হার সারা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। তাছাড়া দেশটির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অত্যধিক পড়ার চাপে কিংবা বৈষম্যের শিকার কিংবা সিনিয়রদের হাতে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে গত বছর জাপানে ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। আর যাদের মধ্যে অনেকের বয়স ছিল কিনা ১৬ বছর বা এর অনেক নিচে। যা একটি উন্নত, প্রযুক্তি সমৃদ্ধ এবং শতভাগ শিক্ষিত জাতি হিসেবে জাপানের কাছে এটা আশা করা যায় না।
জাপানের একাধিক নিউজ এজেন্সির দেয়া তথ্যমতে, গত ২০২৩ সালে সালে জাপানে রেকর্ডকৃত আত্মহত্যাকারী মোট নাগরিকের সংখ্যা ছিল ২১,৮৩৭ জন। যা কিনা গত গত বছর অপেক্ষা ১.৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। যার জন্য দেশের অর্থনৈতিক এবং চাকুরি সংক্রান্ত সমস্যাগুলোকে দায়ী করা হচ্ছে। এদিকে আত্মহত্যা প্রতিরোধে জাপান সরকারের চলতি ২০২৪ সালের শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে যে, গত ২০২৩ সালে অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপে এবং মানসিক নির্যাতনের কারণে দেশটির বিদ্যালয় পর্যায়ে মোট ৫১৩ জন শিক্ষার্থী ও শিশুর আত্মহত্যার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে।
তার পাশাপাশি হতাশাজনক হলেও সত্য যে, চলতি ২০২৪ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার প্রবীণ বা বৃদ্ধ নারী ও পুরুষ নিজ বাড়িতে একাকী থাকা অবস্থায় মারা গেছেন। যার প্রায় কয়েক মাস পর স্থানীয়রা কিংবা পুলিশ বুঝতে পারেন যে তারা মারা গেছেন। এদিকে নিজের পরিবারের সদস্যরা বড় বড় শহরে বাস করলেও কিন্তু গ্রামীণ কিংবা মফস্বল এলাকায় বসবাসরত নিজ পরিবারের অসহায় প্রবীণ ব্যক্তিদের নিয়মিত খোঁজ নেওয়ার সময় পান না তারা। আর এই হলো জাপানের উন্নত সামাজিক ও পারিবারিক উন্নয়নে বাস্তব চিত্র।
এদিকে জাপানের বর্তমান প্রজন্ম নাকি বিবাহ ও পারিবারিক সম্পর্ক বা বন্ধন তৈরির ক্ষেত্রে এক আজব ট্রেন্ডস চালু করেছে। আর তা হচ্ছে সেপারেশন ম্যারেজ বা সাপ্তাহিক বিবাহ কিংবা ফ্রেন্ডশিপ ম্যারেজ। এই সেপারেশন ম্যারেজের ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রী উভয়ই সারা সপ্তাহ নিজের মত কাটালেও পার্টনারের জন্য স্পেশাল একটি দিন বরাদ্দ থাকে। যেদিন তারা একসাথে ঘনিষ্ঠভাবে সময় কাটান, ঘুরতে যান কিংবা একসাথে ডিনার-ডেটে বের হন কিংবা রাত্রী যাপন করেন। এখানে থাকবেনা কোন পারিবারিক বন্ধন এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা।
আর জাপানের বর্তমান প্রজন্মের নারী ও পুরুষ আইনগতভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকলেও কেউ কারো কাজে বা ব্যক্তিগত বিষয়ে কোন হস্তক্ষেপ করবে না এ সংক্রান্ত চুক্তি তারা বিবাহের আগেই সম্পন্ন করে ফেলে। এমনকি সারা সপ্তাহ ব্যাপী তারা একসাথে থাকবেন না এবং নিদিষ্ট একটি দিনে একত্রে মিলিত হবেন। আবার সন্তান ধারণ ও লালন পালনে চরম অনীহা বোধ করেন জাপানের বর্তমান প্রজন্মের একটি বড় অংশ। আর এই ধরনের আজব ও সমাজ বিমুখ রীতিনীতির জন্য আজ জাপানের জনসংখ্যা বর্তমানে আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেতে শুরু করেছে।
তাছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর আগে অর্থাৎ ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সমগ্র এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে জাপান প্রায় ২.৫ কোটি সাধারণ ও নিরীহ মানুষ হত্যা করে এক কলঙ্কজনক ইতিহাস রচনা করে রেখেছে। আর ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, বার্মা, দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীনের সুবিশাল অঞ্চলে দীর্ঘ ৮ বছর ব্যাপী ভয়ংকর সামরিক আগ্রাসন এবং গণহত্যা চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি তার সাথে ধ্বংস করে ফেলে শত শত শহর ও জনপদ।
তথ্যসূত্র: নিপ্পন, জাপান টাইমস, স্টাটিস্টা, নিক্কেই এশিয়া, মেইনিচি ডট জেপি।