প্লুটোর গ্রহত্ব বাতিল হলো কেন?

Sep 3, 2024 - 13:14
Sep 3, 2024 - 13:15
প্লুটোর গ্রহত্ব বাতিল হলো কেন?

১৯৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লোয়েল মানমন্দিরে কাজ করছিলেন মার্কিন জ্যোতির্বিদ ক্লাইড টমবাউ। পর্যবেক্ষণ সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন এই তরুণ জ্যোতির্বিদ। ইউরেনাস ও নেপচুনের কক্ষপথ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে বিজ্ঞানীদের মনে হয়, কিছু একটা ঠিক নেই। গ্রহ দুটির মধ্যে তৃতীয় আরেকটি বস্তু থাকায় এগুলোর কক্ষপথে বিচ্যুতি দেখা যাচ্ছে বলে মনে হয় তাঁদের। তৃতীয় অজানা এই বস্তুর নাম দেওয়া হয় ‘প্লানেট এক্স’। টমবাউ মূলত এই প্লানেট এক্সের সন্ধান করছিলেন। সে জন্যই তিনি চোখ মেলে রেখেছিলেন আকাশে। কিন্তু বিধি বাম। প্লানেট এক্সের বদলে তিনি খুঁজে পান ছোট্ট এক বস্তু। পরে আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি, যুক্তরাজ্যের রয়েল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের সদস্যরা সম্মিলিতভাবে বস্তুটিকে গ্রহ হিসেবে চিহ্নিত করেন।

এসেছে নতুন গ্রহ, সে জন্য নামও তো লাগবে। সাধারণত আবিষ্কারক ও সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা গ্রহের নাম রাখেন। আগের গ্রহগুলোর ক্ষেত্রে মোটাদাগে তা-ই হয়েছে, বলা যায়। এবারে কিন্তু ভিন্ন ব্যাপার হলো। লোয়েল মানমন্দির নামকরণের জন্য প্রতিযোগিতার ঘোষণা দিল রীতিমতো। ১১ বছরের কিশোরী ভেনেশিয়া বার্নি থাকর ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড শহরে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের রোমান দেবতার নামে গ্রহটির নাম রাখার কথা ভাবল সে। এ কথা সে তারা দাদাকে জানায়। তিনিই এ নাম জমা দেন সেই প্রতিযোগিতায়। তারপরেরটা ইতিহাস। সর্বসম্মতিক্রমে এর নাম রাখা হয় প্লুটো।

তারপর প্রায় ৭৬ বছর ধরে সৌরজগতের নবম গ্রহের মর্যাদা নিয়ে ভালোই ছিল ছোটখাটো প্লুটো। ১৯৭৮ সালে হিমশীতল প্লুটোর প্রথম প্রাকৃতিক উপগ্রহ শ্যারন আবিষ্কৃত হয়। পরে হাবল টেলিস্কোপের কল্যাণে আরও চারটি উপগ্রহ আবিষ্কার হয় গ্রহটির। ২০০৫ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে এই চারটি গ্রহ আবিষ্কৃত হয়।

পরিবারের ছোট গ্রহটির দুঃখে তাঁরা একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন। পৃথিবীর প্রায় ৫০০ কোটি কিলোমিটার দূরের প্লুটোর গ্রহত্ব ফিরিয়ে দিতে দেশে দেশে মানুষ বিক্ষোভ করেছে। বিজ্ঞানীদের অবশ্য তাতে মন গলেনি।

সবকিছু ঠিকই চলছিল। কিন্তু কপাল খারাপ প্লুটোর। গ্রহের ফেরে পড়ে গেল। ফলে বিপত্তি বাঁধল ২০০৬ সালে। না, বিপত্তিটা প্লুটোতে বাঁধেনি। ঝামেলাটা পাকিয়েছেন পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা। সে বছর তাঁরা গ্রহের সংজ্ঞায় কিছুটা পরিবর্তন আনেন। আসলে, পরিবর্তন আনাটা জরুরি ছিল। কারণ, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের সামনে আরও ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত হচ্ছিল মহাবিশ্ব। একের পর এক বিভিন্ন ধরনের মহাজাগতিক বস্তু আবিষ্কৃত হতে থাকে। এসব বস্তুকে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করে সেগুলো নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন দেখা দেয়। সেই সূত্র ধরেই ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির বিজ্ঞানীরা গ্রহের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনেন। আর সেই পরিবর্তনের কারণেই সৌরজগতের কনিষ্ঠ গ্রহটি পড়ল বিপদে।

উল্টোপাল্টা আচরণ করলে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয় অনেক সময়। কখনো কখনো অফিসে বস দু-চারটা বকাও দেন। অথচ বিজ্ঞানীরা বেচারা প্লুটোকে গ্রহের তালিকা থেকেই বাদ দিয়ে দিলেন! কেড়ে নেওয়া হলো গ্রহত্বের মুকুট।

সবাই অবশ্য বিজ্ঞানীদের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। পরিবারের ছোট গ্রহটির দুঃখে তাঁরা একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন। পৃথিবীর প্রায় ৫০০ কোটি কিলোমিটার দূরের প্লুটোর গ্রহত্ব ফিরিয়ে দিতে দেশে দেশে মানুষ বিক্ষোভ করেছে। বিজ্ঞানীদের অবশ্য তাতে মন গলেনি। প্লুটো গ্রহের তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেছে। এখন এটিকে বলা হয় বামন গ্রহ। ইংরেজিতে বলে, ডোয়ার্ফ প্ল্যানেট।

সবই তো বোঝা গেল, প্রশ্ন হলো—আসল কারণটা কী? ঠিক কী না মেলায় বাদ পড়ে গেল প্লুটো?

২০০৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন নতুন যে নিয়ম তৈরি করে, তাতে বলা হয়, কোনো মহাজাগতিক বস্তুকে গ্রহ বলতে হলে তাকে অবশ্যই তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে।

এক, পর্যাপ্ত ভর থাকতে হবে, যাতে মহাজাগতিক বস্তুটি নিজের ভরের কারণে প্রায় গোলকের মতো আকার ধারণ করতে পারে। দুই, সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতে হবে। তিন, এর আশপাশের অঞ্চল বস্তুটির কারিকুরিতে পরিচ্ছন্ন হতে হবে। শেষের শর্তটি বোঝা একটু কঠিন। অথচ এই মহাজাগতিক ঝাঁট দেওয়ার অক্ষমতার কারণেই বাদ পড়ে প্লুটো।

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, প্লুটো তার চারপাশের অঞ্চল পরিষ্কার করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী মহাকর্ষ ক্ষেত্র তৈরি করতে পারেনি। পাশাপাশি একই রকম আরও বেশ কিছু মহাজাগতিক বস্তুর দেখা মেলে প্লুটোর আশপাশে।

আসলে, চারপাশের অঞ্চল পরিচ্ছন্ন করার অর্থ হলো, গ্রহের মহাকর্ষ ক্ষেত্র যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়া। যাতে চারপাশের অঞ্চলে গ্রহটির মহাকর্ষীয় রাজত্ব থাকে। বিষয়টা আরেকটু খোলাসা করা যাক। মহাকাশে গ্রহের চারপাশ সব সময় পরিষ্কার থাকে না। নানারকম পাথুরে কণা, গ্রহাণু বা উপগ্রহ হওয়ার মতো উপাদান থাকতে পারে। গ্রহের জন্মের সময়েই এসব উপাদান চারপাশে জড়ো হয়। এ ছাড়া গ্রহাণু আছড়ে পড়া ও উল্কাপাতের মতো ঘটনার কারণে বালি-পাথরের আবর্জনা সৃষ্টি হয় চারপাশে। এসব উপাদানের ওপর গ্রহটি মহাকর্ষীয় কর্তৃত্ব কায়েম করলে উপাদানগুলো হয় গ্রহের সঙ্গে মিশে যায়, নয়তো নির্দিষ্ট কক্ষপথ ধরে গ্রহটিকে প্রদক্ষিণ করে। কখনো-বা উপগ্রহে পরিণত হয়। মহাজাগতিক বস্তুর মহাকর্ষ ক্ষেত্র পর্যাপ্ত শক্তিশালী না হলে এগুলো ঘটে না। সে ক্ষেত্রে চারপাশের অঞ্চল অপরিষ্কার থেকে যায়।

আগেই বলেছি, প্রথম দুটো শর্তে প্লুটো বেশ ভালোভাবেই উৎরে যায়। মহাকর্ষ কাজে লাগিয়ে নিজেকে গোলাকার করার মতো যথেষ্ট ভর আছে প্লুটোতে। ঘোরেও সূর্যকে কেন্দ্র করে। কিন্তু তৃতীয় শর্তটি প্লুটো পূরণ করতে পারেনি শত-কোটি বছরেও। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, প্লুটো তার চারপাশের অঞ্চল পরিষ্কার করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী মহাকর্ষ ক্ষেত্র তৈরি করতে পারেনি। পাশাপাশি একই রকম আরও বেশ কিছু মহাজাগতিক বস্তুর দেখা মেলে প্লুটোর আশপাশে। এই দুইয়ে মিলে গ্রহের তালিকা থেকে প্লুটোকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বিজ্ঞানীরা। তবে প্রথম দুটি শর্ত যেহেতু পূরণ করেছে, তাই প্লুটোকে ডোয়ার্ফ প্ল্যানেট বা বামন গ্রহের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের সংজ্ঞা অনুযায়ী, সূর্যের চারদিকে ঘোরে এবং নিজের আকার গোলকের মতো করার মতো যথেষ্ট ভর আছে, এমন বস্তুকে বামন গ্রহ বলা হবে। সে ক্ষেত্রে নিজের চারপাশের অঞ্চল পরিছন্ন রাখার শর্তটি আর ওই বস্তুকে পূরণ করতে হয় না। শুধু ঝাঁট দিতে না পারায় রাজত্ব হারানোর এরকম ঘটনা আর কখনো ঘটেছে বলে কেউ শোনেনি।

নানারকম পাথুরে কণা, গ্রহাণু বা উপগ্রহ হওয়ার মতো উপাদান থাকতে পারে। গ্রহের জন্মের সময়েই এসব উপাদান চারপাশে জড়ো হয়। এ ছাড়া গ্রহাণু আছড়ে পড়া ও উল্কাপাতের মতো ঘটনার কারণে বালি-পাথরের আবর্জনা সৃষ্টি হয় চারপাশে।

তবে গ্রহের তালিকা থেকে বাদ পড়লেও একা হয়ে পড়েনি প্লুটো। শুধু সৌরজগতেই প্লুটোর মতো আরও ৫টি বামন গ্রহ আছে। এর মধ্যে প্লুটোসহ মাকিমাকি, হাউমেয়া, এরিস—এই চারটির অবস্থান নেপচুনের কক্ষপথের বাইরে। মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝখানে অ্যাস্টেরয়েড বেল্ট বা গ্রহাণু বেষ্টনীর মধ্যে রয়েছে আরেকটি বামন গ্রহ—সেরেস।

তবে গ্রহত্ব হারালেও প্লুটোর বাড়তি খাতির রয়েছে এখনো। সৌরজগতের আর দশটি বামন গ্রহ নিয়ে আলাপ না হলেও প্লুটোকে নিয়ে হচ্ছে বিস্তর আলাপ। রাজ্য হারালেই যে রাজা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে না, তার ভালো উদাহরণ হতে পারে প্লুটো, কী বলেন?

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, ওয়ান্ডারপোলিস, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন